মাগুরা প্রতিনিধিঃ | ১৬:৫৪, ডিসেম্বর ২৭, ২০২১ | 155
মাগুরা প্রতিনিধিঃ
মাগুরায় এক শিশু গৃহকর্মীর উপর দেড় বছর ধরে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত গৃহবধূকে আটক করেছে পুলিশ। গৃহকর্তা স্বামী পলাতক। নির্যাতনের শিকার শিশুটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মানসিক ভারসাম্যহীন বাবা ও শিশু আকলিমাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যান শিশুটির মা। কিছুদিন পরে বাবাও সংসার ছেড়ে হন নিরুদ্দেশ। এরপর থেকে দাদা-দাদীর আশ্রয়ে বড় হচ্ছিলো ১১ বছর বয়সী শিশু আকলিমা। এ অবস্থায় দরিদ্রতার কারণে দেড় বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালী এক প্রতিবেশির বাচ্চার দেখাশোনার কাজের জন্য ঢাকার বাসায় কাজ করতে পাঠানো হয় শিশু আকলিমাকে। সেখানে প্রায় ১৮ মাস অবস্থানকালে প্রতিনিয়ত অমানুষিক নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় আকলিমা।
সামান্য কারণে তার উপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। তিনবেলা খাবার খেতে না দিয়ে মারধরের পাশাপাশি তাকে খাওয়ানো হয়েছে গৃহকর্তার শিশুর বমি ও প্রস্রাব। রাতভর বাথরুমে, কখনো বারান্দায় ফেলে রেখে দেওয়া হতো তাকে। মাগুরা সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিছানায় শুয়ে করুণ কণ্ঠে নিজের উপর নির্মম নির্যাতনের এমনই বর্ণনা দিচ্ছিলো নির্যাতনের শিকার বাবা-মা হীন শিশু আকলিমা।
সারা গায়ে আঘাতের ক্ষত আর কঙ্কালসার শরীর নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয় সে। আকলিমার বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার বাহারবাগ গ্রামে। সে ওই গ্রামের কুবাদ শেখের মেয়ে।
শিশুটির দাদার দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে শিশুটিকে দেখে তার নিজ মুখে নির্যাতনের কথা শোনেন মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। রাতেই অভিযুক্ত বাবু শেখের মাগুরা কলেজ পাড়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বাবু’র স্ত্রী লিপি বেগমকে আটক করে পুলিশ।
আকলিমার দাদি মনোয়ারা বেগম জানান, তিন বছর আগে তাঁর ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারালে ছেলের বউ তাঁকে ছেড়ে অন্য আরেক জনকে বিয়ে করেন। এর কিছুদিন পর ছেলেও অন্যত্র চলে যায়। নাতনি আকলিমাকে প্রথমে মাদ্রাসা ও পরে স্থানীয় স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর প্রতিবেশী বাবু শেখ নামে এক ব্যক্তি তার শিশু সন্তানকে দেখাশোনার কাজের কথা বলে আকলিমাকে ঢাকার মিরপুর-২ এর বাসায় নিয়ে যায়।
বিনিময়ে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা ও তার ভরণপোষণ দেওয়ার কথা বলেন তারা। দীর্ঘ ১৮ মাস ঢাকাতে থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝে ফোনে কথা হলেও আকলিমা ভালো আছে বলে জানানো হয়। এ অবস্থায় গত বুধবার তাকে মাগুরাতে নিয়ে আসে গৃহকর্তা বাবু শেখ। এরপর তার শরীরের কংকালসার অবস্থা দেখতে পান তাঁরা।
পরবর্তীতে নাতনির কাছে জানতে পারেন তার উপর অমানুষিক নির্যাতনের কথা। তিনবেলা খাবারও দেওয়া হয়নি তাকে। এমনকি লিপি খাতুন বাচ্চার খাবারে নজর দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগে সেই বাচ্চার করা বমি ও প্রস্রাব খাইয়েছে আকলিমাকে।
আকলিমার দাদা তজলু শেখ অভিযোগ করেন দরিদ্র্যতার কারণে নাতনির ভরণপোষণ ও ভবিষ্যৎতে বিয়ের দায়িত্ব গ্রহণের কথা বলায় বাবু শেখের কাছে কাজে দিয়েছিলেন তারা। নির্মম এ নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিকের সহায়তায় গৃহকর্তা ও তার স্ত্রী লিপি খাতুন-এর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার মাগুরা সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন তিনি।
মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক রফিকুল আহসান জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে শিশুটিকে জরুরী বিভাগে আনা হলে তার অবস্থা দেখে ভর্তি করা হয়। এসময় তার শরীরে দীর্ঘদিন ধরে চলা নির্যাতনের একাধিক চিহ্ন পাওয়া গেছে। শিশুটি অভুক্ত থাকায় চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে বলেও জানান তিনি।
অভিযুক্ত লিপি খাতুনের স্বামী বাবু শেখ-এর সঙ্গে মোবাইলে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে বারবার এই প্রতিবেদকের সংগে আলাদা সাক্ষাৎ করতে চান তিনি।
এ ব্যাপারে মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম জানান, শিশুটির দাদার করা অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিজে হাসপাতালে গিয়ে শিশুটির খোঁজখবর নিয়েছি। এ ঘটনায় রাতেই অভিযুক্ত লিপি খাতুনকে মাগুরার কলেজ পাড়ার বাসা থেকে আটকের পর জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। অপর অভিযুক্ত বাবু শেখ পলাতক রয়েছে।
তিনি কলেজ পাড়ার বাসিন্দা মশিউর রহমান বকুল-এর ছেলে। মিরপুর-২ এর একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তিনি ওষুধ কোম্পানি ইনসেপ্টাতে কর্মরত আছেন বলে জানা গেছে। তাকে আটকের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে।