শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৬:২২, ফেব্রুয়ারী ২, ২০২২ | 143
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে গৃহস্থালি কাজে জাতীয় গ্রিডের গ্যাস-সংযোগ বন্ধ। এর ফলে বাসাবাড়িসহ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। তবে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের সংকটও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একশ্রেণী অসাধু ব্যবসায়ী ও চক্র মিলে এই সংকট তৈরি করছেন। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এলপিজির খালি সিলিন্ডার সংগ্রহ করে তা কেটে কেজি দরে বিক্রি করে। এতে বাজারে সিলিন্ডারের সংখ্যা কমতে থাকে। তৈরি হয় সংকট। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, এভাবে সিলিন্ডার কাটা পরিবেশ ও মানবসমাজের বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড বেআইনি।
এলপিজি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, গত ৮-৯ মাস ধরে বাজারে সিলিন্ডার সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ সিলিন্ডার খালি হওয়ার পর গ্রাহক আবারও তা গ্যাস রিফিলের জন্য ফেরত নিয়ে আসার কথা। কিন্তু যে পরিমাণ সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে, তার সব রিফিলের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে আসছে না। প্রতিবারই নতুন করে বাজারে সিলিন্ডার ছাড়তে হচ্ছে। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্টিল রি-রোলিং মিল ও স্ক্র্যাপ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবহৃত খালি সিলিন্ডারগুলো সংগ্রহ করছেন। পরে তা কেটে ও গলিয়ে স্ক্র্যাপ তৈরি করে কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, শরিয়তপুর, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, বাগেরহাটের কাটাখালী, খুলনার শেখ পাড়া, কুষ্টিয়ার বড় বাজার, ফরিদপুরের কমরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের কাজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
গ্রাহক বাড়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তুকি দিয়ে তৈরি, খরচের চেয়ে কম দামে সিলিন্ডার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এই ব্যবসার ধরন হলো, ভোক্তা যখন তার খালি সিলিন্ডার রিফিল করতে ফেরত আসবেন, সেই লভ্যাংশ থেকেই ক্রমান্বয়ে মুনাফা পাবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অবৈধভাবে স্ক্র্যাপ তৈরির কারণে এলপিজি সিলেন্ডার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কুমিল্লার কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সহিদুর রহমান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘এলপিজি সিলিন্ডার কেটে টুকরো করে বিক্রির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এই বিষয়ে তদন্ত চলছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মেঘনা ফ্রেশ এলপিজির চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ নুরুল আলম ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘একটি এলপিজি সিলিন্ডার তৈরিতে আমাদের খরচ হয় ২ হাজার ৬০০ টাকা। আমরা যখন তা ভোক্তার কাছে বিক্রি করছি, তখন সেটি তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ভর্তুকি দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে প্রতিটি সিলিন্ডারের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৭০০-৮০০ টাকা। প্রথমবার ব্যবহারে সিলিন্ডারটি খালি হওয়ার পর ভোক্তা যখন আবারও এটি রিফিল করতে ফেরত আসেন, সেখান থেকেই আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ করে। এই ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অথচ বাসাবাড়ি বা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খালি সিলিন্ডার কমদামে কিনে নিয়ে কেটে স্ক্র্যাপ তৈরি করছে।’
নুরুল আলম আরও বলেন, ‘বিস্ফোরক আইনে বলা আছে, সিলিন্ডারের আকার পরিবর্তন করা যাবে না। এরপরও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ছে। এছাড়া গ্যাস একটি দাহ্য পদার্থ। তাই গ্যাস সিলিন্ডারকে যেনতেনভাবে কেটে ফেলাও মারাত্মক ঝুঁকির কাজ।’
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিস্ফোরক পরিদফতরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আব্দুল হান্নান ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘‘এক্সপ্লোসিভস অ্যাক্ট ১৮৮৪’-এর অধীনে ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১’-এ বলা হয়েছে,‘সিলিন্ডারের রঙ পরিবর্তন করা যাবে না। কেউ কোনো সিলিন্ডার কাটতে পারবে না। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সিলিন্ডারের আকৃতি পরিবর্তন-পরিমার্জন করার সুযোগ নেই। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহন, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবহারসহ প্রতিটি বিষয়ে সু‘স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটা আইনের লঙ্ঘন। আর তা পরিবেশ ও জানমালের জন্যও বড়ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
উল্লেখ্য, বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে প্রতিবছরে গড়ে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে এলপিজির চাহিদা। এলপিজির চাহিদার মোট ৯৮ শতাংশই সরবরাহ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহ করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। দেশে এখন প্রায় ৭০ লাখ পরিবার এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সূত্র বলছে, দেশে মোট ৫৬টি কোম্পানি এলপিজি ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নিয়েছে। ২৮টি কোম্পানি বর্তমানে বাজারে সক্রিয়। এর মধ্যে ২০টি কোম্পানি সরাসরি আমদানি করে। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দেশে ২০০০ সালে প্রথম এলপিজি সরবরাহ শুরু করে বসুন্ধরা। এরপর সিলিন্ডার উৎপাদনে আসে ওমেরা, ওরিয়ন,মেঘনা, যমুনা, নাভানার মতো ব্র্যান্ড। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এলপিজি আমদানি, বোতলজাত ও বাজারজাত করছে।
Developed By Muktodhara Technology Limited