শিরোনাম
অনলাইন ডেক্স | ১৩:৩৯, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২২ | 211
জমি নিয়ে বিরোধ থেকে সহিংসতার খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসে। দেশে জমিসংক্রান্ত সহিংসতা ও মানুষের নিরাপত্তার ওপর তার প্রভাব এবং জমির মালিকানার ক্ষেত্রে নারীর বঞ্চনার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) করা তিনটি গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, দেশে জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতা, প্রাণহানি, আহত মানুষের সংখ্যা ও মামলা বাড়ছে।
জমি নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতা কীভাবে জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলে, সেই বিষয়টিও সিজিএসের গবেষণায় এসেছে। গবেষকেরা বলছেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধ থেকে হামলা, খুন, মামলা, সম্পত্তি ধ্বংস, দখল, অপহরণ, জিম্মি করা ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। দেশের প্রায় ৫০ লাখ পরিবার সরাসরি জমিসংক্রান্ত বিরোধের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার ভবিষ্যতে জমি নিয়ে বিরোধের আশঙ্কায় রয়েছে। আদালতে জমিসংক্রান্ত প্রায় ১৪ লাখ মামলা অমীমাংসিত।
সিজিএসের ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও জমি নিয়ে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ভূমিসম্পদের ঘাটতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জমি নিয়ে বিরোধ ও সহিংসতার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, নদীভাঙন ও উপকূলে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে আবাদি জমি সীমিত হয়ে আসছে। অনেকে জমি নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছেন। সহিংসতা বাড়ছে উপকূল ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকায়।
‘জমিসংক্রান্ত সহিংসতার লৈঙ্গিক রূপ ও জমির মালিকানায় নারীর বঞ্চনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জমি নিয়ে বিরোধে নারী ও শিশুর জীবনে প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, জমির বিরোধের কারণে সহিংসতা ও মামলার শিকার হচ্ছেন নারীরা। জমিতে মালিকানা কম থাকা সত্ত্বেও নারীরা জমির জন্য পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীর লক্ষ্যবস্তু হন। জমির বিরোধে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীদের।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ভূমিসংক্রান্ত সহিংসতা অনেক বেশি। আর সেটা দিন দিন বাড়ছেও। আমরা কখনোই বলব না যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমস্ত কর্মচারী সততা মেনে কাজ করেন। তবে ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা সমাধানের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’
করোনাকালে কেন সহিংসতা বাড়ল, জানতে চাইলে বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন,করোনার কারণে গ্রামাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল ছিল। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সহিংসতা বাড়ার পেছনে সেটিও একটি কারণ হতে পারে।
সিজিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২০—এ ছয় বছরে দেশে মোট ২০ হাজার ৪৬৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতি ১৭টি খুনের একটির নেপথ্যে ছিল জমিসংক্রান্ত বিরোধ। এ ছাড়া একই সময়ে মোট ২৮ হাজার ৯৭১টি হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতি ২০টি হামলার একটি হয় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে।২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতায় নিহত হন ১ হাজার ২১০ জন। আহত হন ১৪ হাজার ১৫৬ জন। এর পাশাপাশি লাঞ্ছিত করা, সম্পত্তি ধ্বংস, মারামারি, যৌন নিপীড়ন ও অপহরণের মতো সহিংসতাও ছিল। সংঘর্ষের ঘটনা মূলত ঘটে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে।
সিজিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, জমি নিয়ে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শারীরিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সুস্থতাও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। উদ্বিগ্ন মানুষজনের জীবন ও জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।যেমন লক্ষ্মীপুরের কৃষক আলী আকবর হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত পাঁচ আসামির চারজনই একই পরিবারের। এর মধ্যে জসিম ও তৌহিদুর দুই ভাই। তাঁদের বাবা নুরুল ইসলাম এবং বোনজামাই সফিকুর রহমানেরও হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।
জসীমের স্ত্রী উম্মে হাবিবাও এই মামলার আসামি ছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি খালাস পেয়ে ছয় বছরের সন্তানসহ বাবার বাড়িতে চলে গেছেন তিনি। বাঁশের বেড়া–টিনের ছাউনির ঘরে আছেন শুধু বৃদ্ধ মা ছমিরা বেগম। স্বামী, দুই সন্তান, মেয়েজামাইসহ একসঙ্গে পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুদণ্ডে একা বাড়িতে করুণ ও নিঃসঙ্গ দিন কাটছে তাঁর।
জমিসংক্রান্ত সহিংসতার সংবাদ বিশ্লেষণ করে সিজিএসের গবেষকেরা দেখেছেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে সহিংসতায় ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এর পরে রয়েছে হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, ঢাকা, সিলেট ও বগুড়া। এসব জেলার প্রতিটিতে ৪০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর সিরতা ইউনিয়নের নয়াপড়া গ্রামে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় দুই ভাই রফিকুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলাম নিহত হন। ৪৫ বছর আগে জমি নিয়ে এমন বিরোধ থেকেই তাঁদের দুজন পূর্বপুরুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার মো. আহমার উজ্জামান বলেন, চর অঞ্চলে এ ধরনের সহিংসতা বেশি হয়। পুলিশ সহিংসতাপ্রবণ এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছে।
অন্য জেলার তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হলেও জমি নিয়ে সহিংসতায় ঢাকায় হত্যার ঘটনা কম। গবেষণায় বলা হয়েছে, অন্যান্য জেলার তুলনায় কৃষি ও জলবায়ুর ওপর ঢাকার নির্ভরশীলতা কম। এ কারণে জমি নিয়ে সহিংসতা ও মৃত্যু কম।
জমি নিয়ে বিরোধের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ নিয়ে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন গবেষকেরা। তাতে দেখা গেছে, ২০১৬ ও ২০২০ সাল ছিল বিশ্বের উষ্ণতম বছর। এ সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০২০ সালের জুনে দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। এতে ফসল নষ্ট, নদীভাঙন ও জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। গবেষকেরা বলছেন, জমিসংক্রান্ত সহিংসতার পেছনে এসব বিষয়ও প্রভাব ফেলেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, পানির লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে জমি নিয়ে সহিংসতা ও খুনের প্রবণতা অনেক বেশি। লবণাক্ততার মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা। এ দুই জেলায় জমিজমাসংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।২০১৪ থেকে প্রতিবছর সহিংসতার মাত্রা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। যশোর ও পটুয়াখালীর তুলনায় বাগেরহাট ও পিরোজপুরে সংখ্যাটা বেশি। বাগেরহাটে পানির লবণাক্ততার ঝুঁকি বেশি বলে সহিংসতা সবচেয়ে বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সহিংসতা বাড়ছে নদীভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে। দেশে প্রধান নদী প্রায় ৩০০টি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, চাঁদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকাগুলো দেশের সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ এলাকা। এর মধ্যে ভাঙন বেশি সিরাজগঞ্জে। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শুধু সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় জমি নিয়ে দেড় শতাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের বিষয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। চাষের জমি দিন দিন কমতে থাকায় মানুষ জমি পেতে যত লড়াই করছে, সহিংসতার ঘটনাও তত বাড়ছে।দেশে জমিসংক্রান্ত সহিংসতার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ে কথা হয় জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, নদীভাঙন হাজার বছরের প্রক্রিয়া। নদী ভাঙে, চর জেগে ওঠে। সেই চরের দখল নিয়ে মারামারিও হয়। জমি নিয়ে সহিংসতায় সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যায় না। তবে বায়ুমণ্ডল যত উষ্ণ হচ্ছে, মানুষ তত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সামাজিক অশান্তি বাড়ছে।
নারীরা জমির জন্য পরিবারের সদস্য, স্থানীয় লোকজন এমনকি প্রতিবেশীর লক্ষ্যবস্তু হন। প্রতিপক্ষ পরিবারে জমির বিরোধ থেকে নারীদের ওপর হামলা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বয়স্ক ও বিধবা নারীরা সম্পত্তির জন্য ছেলে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হন।২০১৫ সালের ১৫ জুলাই পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে স্কুলপড়ুয়া এক মেয়ে ও তার দাদি দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে জমির বিরোধ থেকে যৌন নির্যাতনের শিকার ১৫ নারীর মধ্যে চারটি শিশু বা স্কুলপড়ুয়া রয়েছে। পাঁচজন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
গবেষকেরা বলছেন, নারীরা গ্রামীণ কৃষিজমির মাত্র ৪ শতাংশের মালিক। ১০ শতাংশের কম নারীর সম্পত্তির নথিপত্রে তাঁর নাম আছে। নারীর নামে সম্পত্তি নিবন্ধন কর ফাঁকির একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেও পুরুষের সমতুল্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে দাবি করে না। এ ছাড়া অসচেতনতা বা কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দিয়ে নারীকে অংশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, জমিসংক্রান্ত ঘটনায় মামলা হলে পুরুষেরা বাড়িছাড়া হন। জমি আগলে রাখেন নারীরা। এতেও নারীরা নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধের বড় কারণ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও দুর্নীতি। উত্তরাধিকারীরা জমির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে জড়ান, যা মেটানোর কার্যকর ব্যবস্থার ঘাটতি আছে। জমির প্রচুর জাল দলিল হয়। রেকর্ডে ভুল হয়, একজনের জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড হয়। বিরোধ তৈরি হয় সীমানা নির্ধারণ নিয়েও। সার্বিকভাবে দুর্বল ব্যবস্থাপনাই বিরোধ ও মামলার কারণ।সিজিএসের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দেশে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সহিংসতা কমাতে সামাজিক নজরদারির পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
Developed By Muktodhara Technology Limited